ঘেটুপুত্র কমলার মামুন

মিডিয়াডটবিডি: প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো সাদা কাগজ। কিছু লেখা নেই তাতে। বলা হলো, 'ধরে নাও এতে লেখা আছে খুশির সংবাদ। আর তা মনে করে হাসতে হবে। সবাই হেসে দেখাল। এবার বলা হলো, লেখাটাতে দুঃসংবাদ আছে মনে করে কাঁদতে হবে। চেষ্টা করল সবাই। কিন্তু টিকল কেবল একজন। দুই পরীক্ষক হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন আসন ছেড়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, 'আমরা কমলাকে পেয়ে গেছি।' সেদিন কাঁদতে পেরেছিল বলেই হাসান ফেরদৌস মামুন খান সুযোগ পেয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের শেষ ছবি 'ঘেটুপুত্র কমলা'য়।

ছবিটি গত বছর জিতেছিল নেপালের 'হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'-এ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার। এ ছবিতে অভিনয় করেই শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে ২০১২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় মামুন। কিছুদিনের মধ্যে এ পুরস্কার হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে জানায় সে।

শুরুর গল্প

২০০২ সালের কথা। বড় বোন তানহা জাফরীন টোকাই নাট্যদলের সদস্য। একদিন জাফরীন তাকে নিয়ে গেলেন নাটকের মহড়ায়। দলপ্রধান শেখ মেহেদি হাসান সাজুকে বললেন, 'ও অনেক ভালো গান করে, একটা গান শোনাতে বলেন।' মামুন তো ভয়ে জড়সড়। অবশেষে গাইতেই হলো। গানটি সবার এত পছন্দ হলো যে পরদিন থেকেই তাকে নাট্যদলে সুযোগ দেওয়া হলো। তখন তার বয়স সবে চার!

টোকাই নাট্যদলে কাজ করার কারণে পরের বছরই একটি টিভি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পায় মামুন। ওই বছরই বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনচিত্র তাকে এনে দেয় তারকাখ্যাতি। ওখানে মাঝির ছেলের ভূমিকায় ছিল ও।

গায়ে মাছের গন্ধ

মামুনকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি এনে দিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ চলচ্চিত্র 'ঘেটুপুত্র কমলা'। ছবিটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছে সে। 'বাইরে কোথাও বের হলে প্রায়ই আমাকে বিব্রত হতে হয়। অনেকেই কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে-তুমি কমলা না? বেশি বিব্রত হই স্কুলে গেলে। বন্ধুরা বলে-ওই দেখ, কমলা আসছে।'

একদিন রাস্তায় বোরকা পরা এক মহিলা পিছু নেয় ওর। ছেলেধরা ভেবে মামুন তো ভয়ে অস্থির! পা চালাল দ্রুত। ততক্ষণে মহিলাও গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। "এতটা ভয় পেয়েছিলাম যে আর হাঁটতে পারছিলাম না। এই সুযোগে মহিলা আমাকে ধরে ফেললেন। বোরকা থেকে মুখ বের করে বললেন, 'বাবা তুমি মাঝির ছেলে না? তোমার বাবা কি এখন তোমাকে মেলায় নিয়ে যান?' ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভীষণ মজা পেলাম। পরে তার অনুরোধে বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনের ডায়ালগটি শুনিয়ে দিলাম-বলছিলাম না বাবা, আজকে অনেক মাছ উঠব। আজ আমারে মেলায় নিয়ে যাইতেই অইব।"

বিজ্ঞাপনচিত্রটি নিয়ে দুঃখের অভিজ্ঞতাও আছে মামুনের। 'তখন সবে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি। প্রথম দিন স্কুলে যেতেই একজন ছাত্র আমাকে দেখে বলে উঠল, 'দেখ! দেখ! জেলের ছেলে আমাদের স্কুলে। ওর সঙ্গে কেউ মিশবি না। ওর গা থেকে মাছের গন্ধ আসবে!'

সবার আগে পড়াশোনা

এত কিছুর মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাক। প্রাথমিক পর্বটা শেষ করেছে শ্যামলীর আদাবরের প্রিপারেটরি চাইল্ড হেভেন স্কুল থেকে। এরপর শ্যামলীর জামিলা আইনুল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সপ্তম শ্রেণীর পাঠ চুকিয়ে আবার আগের স্কুলে। এখন প্রিপারেটরি চাইল্ড হেভেন স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে সে। পছন্দের বিষয় বাংলা। গণিতে একটু ভয়, তার পরও আগ্রহের কমতি নেই মামুনের। 'গণিতে বেশি জোর দিচ্ছি। ইংরেজিটাকেও হেলাফেলায় নিচ্ছি না। এ দুটিতে ভালো ফল হলে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে খুব একটা ভাবতে হবে না।'
ঘেটুপুত্র কমলার গল্পঘেটুপুত্র কমলা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে মামুন


পড়ার পাশাপাশি চলছে কোচিং। সেখানেও জুটেছে অনেক বন্ধু। তবে দুই মাস চলে গেলেও খুব বেশি খাতির এখনো কারো সঙ্গে হয়ে ওঠেনি। 'কোচিংয়ের ফাঁকে অনেকে আড্ডায় মেতে ওঠে। আমার তা আর হয়ে ওঠে না। এ বছরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অংশ নিতে হবে জেএসসি পরীক্ষায়। তাই আমার আপাতত একটাই সাধনা, পড়াশোনা।' বলল মামুন।

বন্ধু আমার রাসেল

বন্ধু রাসেলের প্রতি ওর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। গেল বছর পড়ার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছে ওর কাছ থেকেই। ক্লাস কামাই হলে পড়া দেখিয়ে দিয়েছে। সহযোগিতা করেছে পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে। নতুন স্কুলে সবে ক্লাস শুরু হয়েছে দুই মাস। চাইল্ড হেভেন স্কুলেও রাসেলের মতো কেউ কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছে সহযোগিতার হাত। তবে এই সময়ে কোনো সহপাঠীর সঙ্গেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি। প্রাইমারি পর্বের অনেক বন্ধুর সঙ্গেই দেখা হয়েছে। তাদের নতুন করে পেয়ে খুব ভালো লাগছে বলে জানায় মামুন। এখনো যোগাযোগ আছে রাসেলের সঙ্গে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতা না থাকলে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হতো বলে জানাল মামুন। প্রধান শিক্ষকও ভীষণ আদর করেন। সরাসরি বলে দিয়েছেন-'শুটিংয়ের জন্য ক্লাস মিস হলে কোনো সমস্যা নেই। তবে পরীক্ষা দিতে হবে ঠিকমতো।'

শিক্ষকদের কাছ থেকে জুটছে বাড়তি সমীহ। 'এরই মধ্যে অনেক শিক্ষকই জেনে গেছেন আমার কথা। তবে আপাতত পড়াশোনার বিষয়েই উৎসাহিত করছেন সবাই। আমিও তেমনটাই চাই।'

হতে চায় ডাক্তার

মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করছে মামুন। গান ও বাদ্যযন্ত্রের ওপর দখল আনার জন্য চর্চাটা চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকঠাক। হিপহপ ডান্স শিখছে নৃত্যশিল্পী রাজের কাছে। এসব বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই মা-বাবার। মা জুলেখা বেগম সব সময় উৎসাহ দেন। বাবা কাইয়ুম খান সহযোগিতা করেন নানাভাবে। সব কিছু ঠিক রেখে লেখাপড়াটা যাতে ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে পারে, তার জন্যও দেন নির্দেশনা। বড় হয়ে ছেলে মস্তবড় অভিনেতা হবে, এমন স্বপ্ন কিন্তু মা-বাবা দেখছেন না। তাঁদের ইচ্ছা, ছেলে বড় হয়ে বড় ডাক্তার হবে। তাতে ছেলেরও আপত্তি নেই। ডাক্তার হয়ে পূরণ করতে চায় মা-বাবার স্বপ্ন।

অভিনয়ে বেশি উৎসাহ দেন বড় বোন তানহা জাফরীন। মামুন জানায়, 'স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই আছি অভিনয় নিয়ে। আমার সত্তার সঙ্গে মিশে গেছে এটি। অভিনয়টা চালিয়ে যাবই। তবে লেখাপড়া বাদ দিয়ে নয়।'

মামুনের যত কাজ

চলচ্চিত্র : 'ঘেটুপুত্র কমলা', 'চন্দ্রগ্রহণ', 'জনতার গর্জন', 'বন্ধু মায়া লাগাইছে', 'ওপরে আকাশ'।

এক ঘণ্টার টিভি নাটক : 'পলাতক', 'ফিরে আসা', 'দৌড়' ও 'হারমোনিয়াম'।

ধারাবাহিক নাটক : আবুল হায়াত পরিচালিত 'আলো আমার আলো' ও সালাউদ্দীন লাভলু পরিচালিত 'আনন্দধাম'।

মঞ্চনাটক : 'মেজদিদি', 'উদ্বাস্তু', 'রক্তলাল', 'রোজিনা উপাখ্যান' ও 'রাজার গলায় দড়ি'।

বিজ্ঞাপনচিত্র : বাংলালিংক, বেবি জিংক, প্রাণ ম্যাংগো জুস ইত্যাদি।

,

কোন মন্তব্য নেই: